Sunday, October 14, 2012

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়াতে চায় না সরকার : :মনজুর আহমেদ ও ফখরুল ইসলাম : : প্রথম আলো


তারিখ: ১৪-১০-২০১২

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাড়াতে চায় না অর্থ মন্ত্রণালয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিরোধ দেখা দিয়েছে দাতা সংস্থাটি মনে করে, এই ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপরেই থাকতে হবে


অর্থ মন্ত্রণালয় মনে করে, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষতারও অভাব রয়েছে তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই মনোভাবের সঙ্গে একমত হয়নি আইএমএফ তারা বলেছে, দক্ষতার অভাব থাকলে সেটি বাড়াতে হবে সারা বিশ্বেই সব ধরনের ব্যাংক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর থাকে বাংলাদেশেও তা হতে হবে

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক দেখভালের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা সীমিত কিন্তু এই নজির বিশ্বের কোনো দেশেই নেই ব্যাংক খাতে একক নিয়ন্ত্রক থাকতে হবে, আর সংগত কারণেই সেই নিয়ন্ত্রক হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকতাঁর সুপারিশ হচ্ছে, ‘সক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জবাবদিহিও বাড়িয়ে দেওয়া হোক

আইএমএফের আপত্তি মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইন সংস্কার নিয়েও ফলে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া নিয়েই সন্দেহ দেখা দিয়েছে
 
আইএমএফের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের উপপ্রধান ডেভিড কাউয়েনের নেতৃত্বে একটি মিশন গত ১২ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করে আইএমএফের মিশনটি এসেছিল বর্ধিত ঋণসুবিধার (ইসিএফ) আওতায় দেওয়া অর্থের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করার আগে সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে
 
অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে মিশনের সমাপনী বৈঠকে গত ২৫ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা ব্যর্থতা নিয়ে আইএমএফের প্রতিনিধিদের কাছে বক্তব্য দেন মন্ত্রী বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভীরতা নেই তাদের তদারকি নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থায় বড় ব্যর্থতা আছে হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে তাদেরও ব্যর্থতা রয়েছে ২০১০ সালে শেয়ারবাজার পতনেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতা আছে

এসব কারণে মন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ তদারকি এবং বেসরকারি ব্যাংকের মতো পর্ষদ শীর্ষ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কোনো আইনি ক্ষমতা দিতে চান না তবে মন্ত্রীর বক্তব্যে আইএমএফ মিশন সম্মতি দেয়নি ওই বৈঠকেই তারা বলেছে, এটা কেবল বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাপার নয়, বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতেই সব ব্যাংকের তদারকি কর্তৃত্ব থাকে বাংলাদেশেও সেটা হতে হবে যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষতা, যোগ্যতা না থাকে, সেসব ক্ষেত্রে তা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে প্রতিনিধিরা আরও বলেন, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করছেন তাঁদের একজন পরামর্শকও নিবিড়ভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন মন্ত্রীর সঙ্গে এই বৈঠকের খবর পরদিন একটি ইংরেজি দৈনিকে উল্টোভাবে প্রকাশিত হয় সেখানে লেখা হয়, ‘আইএমএফ মিশন সাম্প্রতিক ঋণ কেলেঙ্কারি গত বছরের শেয়ারবাজার ধসের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অর্থমন্ত্রীও তাতে একমত হন বিষয়ে আইএমএফের একটি সূত্র জানায়, তারা এই প্রতিবেদনের বিষয়ে অর্থসচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আপত্তি জানিয়েছে

সূত্র জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয় আইএমফের শর্ত আমলে না নিয়ে নতুন এক উদ্যোগ নিচ্ছে একটি ব্যাংক সংস্কার কমিশন বা আর্থিক খাতে বড় অনিয়ম প্রতিরোধ কোষ গঠন করতে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম খুঁজে ফিরছে অর্থ মন্ত্রণালয় ধারণা করা হচ্ছে, আইএমএফের কাছে সংস্কার কমিটির কথা বলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শাসন জোরদার করার আইনি প্রস্তাবকে ঝুলিয়ে দিয়ে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ আদায় করার এটি নতুন কৌশল

ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, আইএমএফ চায়, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা তা প্রয়োগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকুক বিশ্বব্যাংক আইএমএফের বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) যোগ দিতে অর্থমন্ত্রী বর্তমানে জাপানে রয়েছেন সেখান থেকে ফিরে ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী একটি সিদ্ধান্ত দেবেন

হঠাৎ আইন সংশোধনী বদলে গেল: ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ সংশোধনের বেশ কিছু প্রস্তাব অনেক দিন ধরেই ঘষামাজা চলছিল এর মধ্যে প্রধান প্রস্তাবই ছিল, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা

বর্তমান ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬() ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যদি সন্তুষ্ট হয় যে, কোনো ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা কোনো পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কোনো ব্যাংকের বা তার আমানতকারীর ক্ষতিকর কাজ রোধকল্পে বা জনস্বার্থে যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চেয়ারম্যান, পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীকে অপসারণ করা প্রয়োজন, তা হলে বাংলাদেশ ব্যাংক কারণ লিপিবদ্ধ করে আদেশের মাধ্যমে তাদের অপসারণ করতে পারবেতবে এই আইনেরই ৪৬() ধারায় সরকার কর্তৃক মনোনীত বা নিযুক্ত কোনো চেয়ারম্যান, পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীকে অপসারণের ক্ষমতা রহিত করা হয়েছে
আইএমএফের ঋণের একটি বড় শর্ত ছিল, এই ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফ যৌথভাবে আইন সংশোধনের বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে বেশ কয়েক দফা আলোচনা করে এবং সেই অনুসারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রস্তাব পাঠানো হয় সরকারের কাছে

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এই আইন সংশোধনে গত মার্চ সাবেক সচিব কে আবদুল মুবিনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে এই কমিটিতে দেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রস্তাবগুলো কমিটিও তাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রস্তাব হুবহু রেখে দেয় বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশ ছিল, কোনো বিশিষ্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীর ক্ষেত্রে ৪৬() ধারা প্রযোজ্য হবে না বিশিষ্ট ব্যাংক বলতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংক রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে বুঝিয়েছে আইএমএফ অবশ্য এই বিশেষায়িত ব্যাংকের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে তাদের খসড়া দলিলে

মন্ত্রণালয় সূত্রগুলো বলছে, কে আবদুল মুবিন কমিটির সুপারিশ অনুসারে সবই ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু হঠাৎ তা বদলে যায় সময়টা উল্লেখ করে সূত্রটি বলে, হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা দুদকে পাঠানোসহ বিভিন্ন ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগী ভূমিকায় অর্থ মন্ত্রণালয় মনোভাব পরিবর্তন করে ফেলে
সূত্র জানায়, এই আইনের আরও একটি বিষয়ে আইএমএফ নেতিবাচক মত দিয়েছে তা হলো, শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলোর মোট বিনিয়োগের হার বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফ মনে করে, ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হবে আদায়কৃত মূলধনের ১০ শতাংশ তবে অন্যান্য সব মিলিয়ে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ হতে পারবে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ কিন্তু মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে পরিমাণটি বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়েছে

খসড়ায় যোগ করা হয়েছে, সরকার চাইলে যেকোনো সময় তা কমাতে পারবে, কোনো অবস্থাতেই বাড়াতে পারবে না অথচ এই আইনি ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার আগে ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে কেননা, বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি প্রণয়ন এবং ব্যাংকগুলো তদারকি নজরদারি করে ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি তদারকির স্বার্থে হার কমিয়ে আনার ক্ষমতা রাখত এটি এখন অর্থ মন্ত্রণালয় তাদের হাতে নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে

ভ্যাট আইন সংশোধন: ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মধ্যে কর-রাজস্ব অনুপাত সাড়ে ১২ শতাংশে উন্নীত করতে আধুনিক কর-ব্যবস্থা, করজাল বিস্তৃত করা, কার্যকর প্রশাসন কাঠামো গড়ে তোলার পরামর্শ ছিল আইএমএফের সংস্থাটি সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয় নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আইনটিতে এটি এখন অনুমোদনের জন্য জাতীয় সংসদে বিল আকারে উত্থাপিত হয়েছে বিলে আইএমএফের সঙ্গে সমঝোতার কিছু শর্তে বড় অসামঞ্জস্যতা করেছে সরকার সমঝোতা ছিল, নির্বিশেষে ১৫ শতাংশ হারে মূসক নির্ধারণের কিন্তু বেশ কিছু খাতে রেয়াতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে ২৩টি খাতে মূসক অব্যাহতিও আছে আরও কিছু খাতে শূন্য হারে মূসক সুবিধা দেওয়া হয়েছে

মন্ত্রিপরিষদের একটি সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত আইনটি আইএমএফের সমঝোতার ভিত্তিতে মন্ত্রিপরিষদে ওঠার পর প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান পরিমার্জন করতে উদ্যোগী হন তাঁর নেতৃত্বে একটি কমিটিও করা হয় সেই কমিটির সুপারিশ মেনেই তা জাতীয় সংসদে পাঠানো হয়
আইএমএফ মনে করে, প্রস্তাবিত আইনটি আবার পরিবর্তন করে ১৫ শতাংশ হারে মূসক নির্বিশেষে নির্ধারণ করতে হবে ছাড়া আগের পরিকল্পনা অনুসারে আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই এনবিআরের নতুন সাংগঠনিক কাঠামোতে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন দেখতে চায় আইএমএফ

আইএমএফের সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, মধ্যমেয়াদি রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০১৩ সালের মার্চ মাসের মধ্যে প্রত্যক্ষ কর আইন তথা আয়কর আইনের ওপর একটি পরিকল্পনা করতে হবে এই নতুন প্রত্যক্ষ কর আইনে করহার যৌক্তিকীকরণের তাগিদও দেওয়া হয়েছে

মূসক আইন নিয়ে আইএমএফের দ্বিমত সম্পর্কে জানতে চাইলে সরাসরি কোনো জবাব দেননি এনবিআরের চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দীন আহমেদ প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা সব পক্ষের মতামত নিয়েই আইনটি চূড়ান্ত করতে চাই তবে শিগগিরই তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না

বিদ্যমান আইন থেকে নতুন আইনে যেতে সময় লাগবে উল্লেখ করে নাসিরউদ্দীন আহমেদ জানান, অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ইতিমধ্যে ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে

Shared from : http://www.prothom-alo.com